ডাকসুর ইতিহাসে সরকারবিরোধী প্যানেলই জয়ী হয়, এবার কী হতে যাচ্ছে

বাংলাদেশের প্রথম সারির পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ঐতিহাসিকভাবে সরকারবিরোধী প্যানেলই বিপুল ব্যবধানে জয়ী হয়েছে। ব্যতিক্রম হয়নি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) নির্বাচনেও। এই নির্বাচন প্রক্রিয়ার জাতীয় রাজনীতির প্রভাব থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতৃত্ব তৈরির এ মঞ্চে চূড়ান্ত পর্যায়ে প্রভাব বিস্তার করতে ব্যর্থ হয়েছে ক্ষমতাসীনরা। এবার ডাকসুর ইতিহাসে ঘটলো নতুন ইতিহাস। অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হচ্ছে এই নির্বাচন।
১৯২২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ডাকসু।স্বাধীনতার পর কয়েকবার নির্বাচন হলেও ১৯৯০-এর দশকের পর থেকে নির্বাচন কার্যত স্থগিত হয়ে যায়। দীর্ঘ বিরতির পর সর্বশেষ ডাকসু নির্বাচন হয় ২০১৯ সালে, স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকার (শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন প্রশাসন, ১৯৭২) কিংবা পরবর্তী কোনো অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি।
অর্থাৎ ২০২৫ সালের এই নির্বাচন হতে যাচ্ছে প্রথমবারের মতো অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে প্রথম ডাকসু নির্বাচন। ফলে প্রশ্ন জাগে-এবারের নির্বাচনেও কি সেই ধারা অব্যাহত থাকবে, নাকি ভাঙবে পুরোনো রীতি?
ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, ছাত্র সংসদ নির্বাচনে সাধারণত সরকারবিরোধী প্যানেলই বিপুল ব্যবধানে জয়ী হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) ভিপি পদে নির্বাচিত হওয়া অনেক নেতা ছিলেন পরবর্তীতে জাতীয় রাজনীতির বড় ব্যক্তিত্ব।
১৯৬৯ সালে ডাকসুর ভিপি নির্বাচিত হন তোফায়েল আহমেদ। তিনি তখন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতা এবং আওয়ামী লীগপন্থি ছিলেন। সে সময় পাকিস্তান সরকারবিরোধী আন্দোলন প্রবল আকারে চলছিল, আর আওয়ামী লীগও ছিল বিরোধী অবস্থানে। ফলে তোফায়েলের বিজয় ছিল সরকারবিরোধীদেরই জয়।
১৯৮৩-৮৪ মেয়াদে ডাকসুর ভিপি নির্বাচিত হয়েছিলেন মাহমুদুর রহমান মান্না। তখন তিনি ছিলেন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ সমর্থিত প্রার্থী। তখন স্বৈরশাসক এরশাদের জাতীয় পার্টি ছিল ক্ষমতায়।
আবার ১৯৯০ সালের ৬ জুন ডাকসু নির্বাচনে ভিপি নির্বাচিত হন আমানুল্লাহ আমান। তিনি ছিলেন বিরোধীশক্তি বিএনপির ছাত্র সংগঠন ছাত্রদলের নেতা। সে সময় ক্ষমতায় ছিল সামরিক শাসক এরশাদের জাতীয় পার্টি। তাই বিএনপিপন্থি প্রার্থী হিসেবে আমানের জয়ও প্রতিফলিত করে সরকারবিরোধী ছাত্রশক্তির উত্থান।
এর ব্যতিক্রম হয়নি ২০১৯ সালেও, যখন নুরুল হক নুর ডাকসুর ভিপি নির্বাচিত হন। তিনি ছিলেন বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের প্রার্থী। ছাত্রলীগ এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ক্যাম্পাসে আধিপত্য বিস্তার করছিল। কিন্তু নুর ছাত্রলীগের ভিপি প্রার্থী গোলাম রাব্বানী ও অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের পরাজিত করেন। তার বিজয় একদিকে ব্যক্তিগত সাহস ও আন্দোলনে নেতৃত্বের প্রতিফলন, অন্যদিকে ছাত্রলীগের দীর্ঘমেয়াদি কর্তৃত্বে জমে থাকা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সদস্য মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান চ্যানেল 24 অনলাইনকে বলেন,‘বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচন মূলধারা রাজনৈতিক ধারার সঙ্গে জড়িত। বড় দলগুলো একে নিজেদের কর্তৃত্ব রক্ষার ইমেজ হিসেবে দেখে। এটি অনেক ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীনদের জন্য লিটমাস টেস্ট হয়ে দাঁড়ায়। তবে দেখা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারবিরোধী প্যানেল জয়ী হয়।’
তিনি আরও বলেন,‘এবারের ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ফলাফলে সেই পুরোনো ধারা ভেঙে ইতিবাচক কিছু ঘটার সুযোগ তৈরি হয়েছে। এখন ক্ষমতায় থাকা অন্তর্বর্তী সরকার কোন দলকে প্রতিনিধিত্ব করে না। এতে করে দলীয় লেজুড়বৃত্তির বাইরে থাকা স্বতন্ত্র প্রার্থীদের পক্ষে ভালো কিছু করার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।’
সব মিলিয়ে বলা যায়, ডাকসুর ইতিহাসে সরকারবিরোধী প্রার্থীরাই জয়ী হওয়ার প্রবণতা দেখিয়েছেন। এবার অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে নির্বাচনে সেই ধারা অব্যাহত থাকবে নাকি নতুন কোনো অধ্যায় রচিত হবে, সেটিই এখন শিক্ষার্থীদের কৌতূহলের কেন্দ্রবিন্দু।